যে ঋণ শোধ হবে না

মুস্তানসীর রশীদ ঋষি
প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০১৭ , ১১:৩৬ এএম
যে ঋণ শোধ হবে না

ভীষণ গরম পড়েছে। প্রিয়মদের স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি দিয়েছে। প্রিয়ম ঠিক করল আম কাঁঠাল খেতে সে দাদু বাড়ি যাবে। তাই ছুটি পাওয়ার পর পরই সে দাদু বাড়ি গেল। প্রিয়মদের দাদু বাড়ি খুব সুন্দর জায়গায়। বাড়ির পাশেই আছে নদী। গ্রীষ্মকালে নদীর পানি শুকিয়ে যায়। কিন্তু নৌকা চলতে কোনো অসুবিধা হয় না। মালপত্রবোঝাই নৌকা চলে নদীতে। আগে লগি-বৈঠা ঠেলে মাঝিরা নৌকা বেয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু এখন প্রায় সবই ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মাঝে-মধ্যে পালতোলা নৌকাও দেখা যায়। নদীর ধারের কাশবনের পাশ দিয়ে যখন পালতোলা নৌকাগুলো যায় তখন সেগুলো অনেক সুন্দর দেখায়।

প্রিয়মের মনে পড়ল বাড়ি গেলে সে এবারও এসব দৃশ্য দেখতে পাবে। তাছাড়া দাদুর কাছেও মজার মজার গল্প শোনা যাবে সেটা ভেবেও সে খুশিতে আটখানা।
বাবা ছুটি পায়নি। তাই মার সাথে প্রিয়মকে দাদু বাড়ি যেতে হল। প্রিয়মকে পেয়ে বাড়ির সবাই অনেক খুশি হল। প্রিয়ম শহরের একটি নামী স্কুলে পড়ে। গ্রামের ছেলেরা তাই ওকে পেয়ে বেশ খুশি। প্রিয়ম যেমন পড়ালেখায় ভাল ঠিক তেমনি গান, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদিতেও অনেক ভাল। কয়েকবার সে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে।

বিকেল বেলাটা প্রিয়ম ওর বন্ধুদের সাথেই কাটালো। রাতের খাবারের পর ও চেপে ধরলো দাদুকে।

দাদুর অনেক বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও বেশ শক্ত সামর্থ্য। নিজের কাজ নিজে করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। দাদুর চুলদাড়ি সব পেকে গেছে। কয়েকটা দাঁতও পড়ে গেছে। এ নিয়ে প্রিয়মের সাথে দাদু মজা করেন। বলেন, দাদু আমি আর আগের মত হাড়গোড় চিবিয়ে খেতে পারি না। আমার বয়স হয়ে গেছে। এবার তোমাদের পালা। প্রিয়ম বলল, মোটেও না। এখনও ঢের ভাল আছ। না হলে এতো সুন্দর করে গল্প বল কী করে। এবার কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই গল্পটা বলে শেষ করতে হবে। দাদু বলল, তোমাদের কাছে গল্প মনে হলেও এসব কিন্তু সবই সত্যি ঘটনা। আমরা সব চোখের সামনে দেখেছি। পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। মেয়েদের ওপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। যাই হোক, তুমি তো সেই পাশা পাগলের গল্প শুনতে চেয়েছিলে। পাশা কিন্তু আসলে পাগল ছিল না। সে ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা।

পাশা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুখস্থ বলতে পারতো। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় যখন পাকবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল, নির্বিচারে তাদের হত্যা করল তখন থেকেই পাশার রক্তে যেন আগুন লাগল। সে লোকজনদের সংগঠিত করতে লাগল। দেশকে এবার স্বাধীন করতেই হবে-এমন প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর।

পাশা তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসলো। একদিন হঠাৎ শোনা গেল জেলা শহরের মেইন রাস্তা ধরে পাকবাহিনী দলবল নিয়ে গ্রামের দিকে আসছে। পাশারাও প্রস্তুতি নিল। রাস্তার পাশে ছিল পাটক্ষেত। পাশারা সেই পাটক্ষেতে পজিশন নিল। এর আগে রাস্তা কেটে এমনভাবে খড়-কুটো বিছিয়ে রাখলো যাতে দেখে মনে না হয় রাস্তা কাটা। পাকসেনারা গাড়ি নিয়ে পাটক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা খেয়ালই করেনি রাস্তা কাটা। সেই কাটা রাস্তায় তাদের গাড়ি গেল আটকে। অমনি পাশারা পাটক্ষেত থেকে গুলি করতে লাগল। গুলি বর্ষণে পাকসেনাদের অনেকেই হতাহত হল। এক সময় তারা দিশেহারা হয়ে শহরের দিকে ফিরে গেল। প্রিয়ম বলল, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু হয়নি। দাদু বলল, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও অনেকে আহত হয়েছে। তবে ভাগ্য ভাল কেউ মারা যায়নি।
এরপর পাক সেনারা পাশা কমান্ডারকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। রাজাকাররা পাকসেনাদের কাছে পাশাকে ধরিয়ে দিল। তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হল। এরপর পাশা ছাড়া পেয়েছিল। সেও আরেক গল্প।

পাশাকে থানায় যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে আগে থেকেই একজন বন্দি ছিল। তার নাম ছিল সাজু। পেশায় চোর। সাজু বলল, পাশা ভাই এখানে থাকলে এরা আপনাকে মেরেই ফেলবে। আমি আপনাকে বের করার ব্যবস্থা করছি। সাজুর কাছে একটা ব্লেড ছিল। সে ব্লেড দিয়ে তার গায়ে আচর কেটে রক্ত বের করল আর চিৎকার করে বলতে লাগল আমাকে বাঁচাও। এমনভাবে চিৎকার করল যেন পাশা তাকে মারছে। চিৎকার শুনে পুলিশ এগিয়ে আসলো। লকআপ খুলতেই আগে থেকেই শিখিয়ে দেয়া কথা অনুযায়ী পাশা সেখান থেকে পালালো। এরপর আবার মুক্তিযুদ্ধে গেল।

অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর এল সেই বহু কাঙ্খিত বিজয়। কিন্তু পাশার মনে কোথায় যেন একটা অশান্তির ছায়া। সে দৌড়ে গেল থানায়। দেখে থানার সামনের রাস্তায় সাজুর ক্ষত-বিক্ষত লাশ। দু’একটা কাক এসে ভীড় করেছে এরই মধ্যে। পাশা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না। সে মনে করলো সাজুর মৃত্যুর জন্য সেই-ই দায়ী। তারপর থেকে পাশার মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা দেখা দিল। এরপর আর সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। দাদু দেখে প্রিয়মের চোখে পানি। দাদু বলল, কেঁদোনা প্রিয়ম, এ রকম অসংখ্য পাশা আর সাজুদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ। তোমাদের এখন তাঁদের ঋণ শোধ করার পালা।