মারিয়ার মন ভালো নেই। মন ভালো না থাকারই কথা। আজও সে একটা পেন্সিল হারিয়েছে। নিশ্চয়ই আজও মা তাকে বকবে। মাঝে মাঝে তাকে বকা শুনতে হয়। মা এখনো অফিস থেকে ফেরেননি। বাবাও অফিসে। বাসায় কেবল রানু আন্টি।
রানু আন্টি বাসায় কাজ করেন। থালা-বাসন ধুয়ে দেন। জামা-কাপড় পরিষ্কার করেন। রুম ঝাড়ু দেন। রান্না করেন। রানু আন্টি সবে কাজকর্ম শেষ করেছেন। একটু পর চলে যাবেন। তখন মারিয়া একা একা বাসায় থাকবে। তার আরো মন খারাপ লাগবে। রানু আন্টি মারিয়াকে বললেন, কি আম্মা, আপনার কী হইছে? চুপচাপ বইসা আছেন?
মারিয়ার কিছু বলতে ভালো লাগছে না। তবু সে বললো, না আন্টি কিছু হয়নি। এমনি এমনি বসে আছি।
আন্টি বললেন, একটু দুধ গরম করে দেব? নাকি বিস্কুট খাইবেন? কথা বলা শেষ না করেই আন্টি আবার রান্নাঘরে ঢোকেন।
কিছুক্ষণ পর একগ্লাস দুধ ও তিনটে বিস্কুট নিয়ে আসেন। টিভি ছেড়ে দিয়ে বলেন, নেন আম্মা, খান আর টিভি দেহেন। একটু পর আপনার আম্মায় আইসা পড়বো।
মারিয়া দুধের গ্লাসটা হাতে নেয়। রানু আন্টি চলে যায়। দুধ খেতে মারিয়ার ভালো লাগছে না। টিভি দেখতেও বিরক্ত লাগছে। একটু পরই মা আসবেন। তখন...
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। মারিয়া মুখ কালো করে দরজা খুলতে গেলো। কিন্তু দরজা খুলেই সে অবাক হয়! ছোটমামা যে... মামা... বলেই সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। মামা হাসতে হাসতে বললেন, তোকে দেখতে চলে এলাম।
মামা রুমে ঢুকে সোফায় বসলেন। তার ছোটমামা আগের বার কত কী নিয়ে তাদের বাসায় এসেছিলো। মারিয়া দেখলো, মামা এবার একটা চকলেটও আনেননি। ছোটমামা যেন মারিয়ার মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন, তোর মন খারাপ দেখে চলে এলাম। নতুবা আসতামই না।
মারিয়া অবাক হয়। আমার মন খারাপ তুমি কী করে জানলে মামা?
মামা হাসেন। মামাদের সবকিছু জানতে হয় বুঝলে? আর তোকে তো অনেক ভালোবাসি মামা।
মারিয়া মামাকে জড়িয়ে ধরে।
মামা বলেন, তুই পেন্সিল হারিয়ে ফেলেছিস্ না? আর সেজন্য মা বকবে- এই ভয়ে মন খারাপ?
মারিয়া মাথা নাড়ে। আম্মু ভীষণ বকবে। গত পরশুও একটা বই হারিয়ে ফেলেছি।
ছোটমামা তার কথা শুনে হো হো করে হাসেন। বলেন, আমি যখন থ্রিতে পড়ি তখন কী হয়েছিলো জানিস্?
মারিয়া আগ্রহ নিয়ে মামার কথা শোনে। মামা বলেন, স্কুল ব্যাগ আর জুতো রেখে মাঠে খেলতে গেছি। কানামাছি খেলছিলাম আমরা। খেলা শেষে ক্লাসে এসে দেখি ব্যাগও নেই, জুতোও হাওয়া!
মারিয়া বিস্ময়ে হা হয়ে যায়, তাই নাকি মামা! তারপর...?
মামা বলেন, তারপর আর কি? অনেক খুঁজলাম। পাইনি। বাড়িতে গেলাম মন খারাপ করে। আব্বা খুব করে বকলেন! তোর আম্মুও একবার ক্লাস ফাইভে থাকতে...
মারিয়া দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে মায়ের কথা শুনবে, এমন সময় মামা বললেন, নাহ থাক। সেটা তোকে বলা যাবে না।
মারিয়া অনেক অনুনয়-বিনয় করলো। কিন্তু মামা বললেন না। মামা বললেন, এখন উঠি রে। অনেক দূর যেতে হবে।
মারিয়া কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ছোটমামা মারিয়ার হাতে একটা পেন্সিল তুলে দেয়। মারিয়া পেন্সিল দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ! এ তো তার হারিয়ে যাওয়া পেন্সিল! কোথায় পেলে মামা?
ছোটমামা হাসতে হাসতে বলেন, এখন যাই রে। আর তোর পেন্সিল হারালে আগে ভালো করে চারপাশ খুঁজবি। না পেলে আমি তো আছিই। মন খারাপ করবি না কিন্তু।
মামা চলে যান। মারিয়ার মন ভালো হয়ে যায়। তার খুব ভালো লাগছে। পেন্সিল পাওয়া গেছে।
একটু পর অফিস থেকে মা আসেন। মারিয়া বলে, মা ছোটমামা এসেছিলেন। মা কথাটা শুনে একটু চমকে ওঠেন। বলেন, কী বলিস্! কথাটা বলেই মা টেবিলের ওপরে তাকান। সেখানে ছোটমামার একটা ছবি আছে। মা আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকেন। মারিয়ার মনে হলো, ছোটমামার কথা শুনে মা একটু মন খারাপ করেছেন। মারিয়া কিছু বুঝতে পারে না। সে হোমওয়ার্ক করতে যায়। মামা পেন্সিলটা না খুঁজে দিলে নিশ্চয়ই মা বকতো। সেদিন মা রাতে বাবার সাথে ফিসফিস করে কী বলছিলেন যেন। বাবা কেবল মারিয়াকে বললেন, জানিস্, ইকবাল, মানে তোর ছোটমামা কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসতো।
দুদিন পর শুক্রবার। মা ও বাবা মারিয়াকে নিয়ে নানু বাড়ি যাচ্ছেন। নানুর বাড়ির সামনে একটা কবরস্থান। বাবা সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার ছোটমামার জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখেন। নানু এসে মারিয়াকে নিয়ে যান। মারিয়া শোনে কে যেন বিমর্ষ গলায় বলছেন, গতবছর যদি ইকবাল অ্যাক্সিডেন্টে চলে না যেত... তাহলে তোকে দেখে তোর মামা কী না খুশি হতো।
মারিয়া কিছুই বুঝতে পারে না। তার মনও খারাপ হয় না। ছোট মামা বলেছেন, পেন্সিল হারালে আগে ভালো করে খুঁজে দেখতে। যদি না পাওয়া যায়, তবে তো মামা আছেনই। তারপর অনেক অনেকদিন কেটে যায়। মারিয়া আর পেন্সিল হারায় না। তবে তার ছোটমামার কথা মনে পড়ে ভীষণ। মামারও যেন আজকাল কী হয়েছে। অনেকদিন হয় তিনি আসেন না।