রোজানের স্বাধীনতা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশিত: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ , ০১:০৫ পিএম
রোজানের স্বাধীনতা

আজ ২৬ মার্চ। সকাল থেকেই চারিদিকে মাইকে একটি কণ্ঠের জোরালো বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে যায় রোজানের। চোখ কচলে আব্বু-আম্মুকে খোঁজে। কেউ নেই রুমে। তারা গেলেন কোথায়? রোজানের আজ স্কুল ছুটি। স্কুলের ম্যাডাম বলেছেন, ‘২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।’ সরকারি ছুটি বলে রোজানের বাবারও নিশ্চয়ই অফিস নেই। তবে মা হয়তো রান্নাঘরে। বাবা তাহলে কোথায়?

 

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে রোজান। উপজেলা শহরে বাস করে তারা। বাবা সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা। গত ডিসেম্বরে রোজান শুনেছে, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই সেদিন বিজয় দিবস। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস আবার আলাদা কেন? অনেকবার জানতে ইচ্ছা করেছে তার। কিন্তু কারো কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এবার বাবাকে খুঁজে বিষয়টা তাকে জানতেই হবে।

 

কলেজ মাঠে সকালের অনুষ্ঠান হচ্ছে। শোভাযাত্রা, কুচকাওয়াজ, মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, খেলাধুলা আরো কত কী। রোজান তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারেনি বলে বাবা হয়তো নিয়ে যাননি। না যেতে পেরে মনটা একটু খারাপই হলো। বাবার উপরও প্রচন্ড অভিমান হলো। কেন নিয়ে গেল না তাকে? এলেই জিজ্ঞেস করবে।

 

অনুষ্ঠানের মাইক থেকে ভেসে আসছে একটি কথা, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স¦াধীনতার সংগ্রাম’। কণ্ঠটি রোজানের চেনা। আগেও বেশ কয়েকবার শুনেছে সে। কণ্ঠটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। জাতীয় দিবস এলেই এই ভাষণ সে শুনে থাকে। তবে যতবারই শুনেছে, ততবারই ভালো লেগেছে। বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়েছে। এমন ভরাট কণ্ঠ সত্যিই ভালো লাগে রোজানের।

 

রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যায় রোজান। সেখানে মা একা রান্না করছেন। কিছু না বলে পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে। ‘কী রান্না করছো আম্মু?’ জানতে চায় রোজান।

 

হাতের তরকারিটা কড়াইতে ঢেলে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রোজানের দিকে তাকায় মা। রোজানের কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বলেন, ‘মামণি, বাসায় মেহমান আসবেন। তাদের জন্য ভালো-মন্দ কিছু রান্না করছি।’

 

রোজান জানতে চায়, ‘আব্বু কোথায় গেছে আম্মু?’

 

রোজানের মা বলেন, ‘তোমার বাবা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গেছেন। আসার সময় মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে আসবেন।’

 

‘কারা আসবে আম্মু?’ রোজানের প্রশ্ন।

 

আম্মু বলেন, ‘তোমার কবি ভাইয়া ঢাকা থেকে আসছেন। আজ সন্ধ্যায় তিনি কবিতা পড়বেন। তার সঙ্গে দু’জন কণ্ঠশিল্পীও আছেন।’

 

মায়ের কথা শুনে রোজান বেজায় খুশি। কবি ভাইয়াকে তার অনেক পছন্দ। ‘যাক ভালোই হলো, কবি ভাইয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাবে।’ বলে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যায়।

 

রোজান রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বাইরে চলে যায়। বাড়ির চতুর্দিকে টিনের বেড়া দেওয়া। ফলে রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতরের কাউকে দেখা যায় না। রোজান কলপাড়ে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করছে। এমন সময় বেশ কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ আসতে থাকে। শব্দগুলো রোজানদের গেটের কাছাকাছি চলে এসেছে।

 

গেটের দরজা ঠেলে রোজানের বাবাসহ আরো তিনজন প্রবেশ করেন। বাড়িতে মেহমান এলে রোজানের ভালোই লাগে। পড়তে বসতে হয় না। মজার মজার খাবার খেয়ে, গল্প করে সময় কাটানো যায়। তারমধ্যে একজন আবার রোজানের চাচাতো ভাই। তাকে ‘কবি ভাইয়া’ বলে রোজান। তিনি এলে সুন্দর সুন্দর ছড়া পড়ে শোনান। এবার বইমেলা থেকে তাঁর কবিবন্ধু পলিয়ার ওয়াহিদের ‘মানুষ হবো আগে’ ছড়ার বইটি কিনে পাঠিয়ে ছিলেন।

 

তাদের আসতে দেখে মুখে ব্রাশ নিয়েই ছুটে যায় রোজান। বাবা বলেন, ‘মামণি, মেহমানদের সামনে মুখ ধুয়ে আসতে হয়।’ রোজান ‘আচ্ছা বাবা’ বলে চলে যায় কলপাড়ে। মেহমানরা বারান্দায় বসতে বসতেই শরবত, সেমাই, ফল, নুডুলস এবং চা দিয়ে গেলেন রোজানের মা। রোজান ততক্ষণে ব্রাশ রেখে তাদের সঙ্গে যোগ দিলো।

 

খেতে খেতে রোজানের সঙ্গে কথা বলছেন রোজানের কবি ভাইয়া। ‘রোজান, কেমন চলছে পড়াশোনা?’

 

‘জ্বি ভাইয়া ভালো।’ ছোট্ট করে জবাব দেয় সে।

 

‘আচ্ছা ভাইয়া, একটা কথা বলো তো আমাকে!’ একটু জোরালো কণ্ঠে কথাটা বলে রোজান। কবি ভাইয়া তার কথায় খুব মনোযোগী হন। কথাটায় বেশ গাম্ভীর্য লক্ষ্য করেন তিনি।

 

‘কী কথা?’ বললেন কবি ভাইয়া।

 

‘১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। সেদিন আমরা বিজয় পেয়েছি। তাহলে আলাদা করে আবার স্বাধীনতা দিবস কেন?’ ছোট্ট রোজানের এমন জ্ঞানগর্ভ প্রশ্নে খুব খুশি হন কবি ভাইয়া।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছো তুমি। তাহলে শোনো, পাক হানাদার এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু তারও আগে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই বর্বর পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। তারা আমাদের বিভিন্নভাবে ঠকাতে থাকে। কথায় কথায় নির্যাতন করতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে পরিবর্তন করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। ফলে সেই সময় থেকেই পাকিস্তানিদের অপচেষ্টার প্রতিবাদ শুরু হয়।’

 

রোজানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকেন কবি ভাইয়ার কথা। তিনি বলতে থাকেন, ‘সেই প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। তার কিছুদিন পর ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ফলে ২৬ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রাম বেতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এই দিনে। তাই পরবর্তীতে এই দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হয়েছে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে।’

 

‘ওহ, আচ্ছা। এবার তবে বুঝেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। এজন্যই তোমাকে এতো ভালো লাগে।’ রোজানের কথা শুনে হাসতে হাসতে কোলে টেনে নেন কবি ভাইয়া।

 

‘আমি কিন্তু রাতে তোমাদের সঙ্গে স্বাধীনতা দেখতে যাবো।’ আব্দার করে রোজান।
‘আচ্ছা, তোমাকে নিয়েই যাবো। সেখানে গেলে তুমি স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে আরো জানতে পারবে।’ বললেন কবি ভাইয়া।

 

রোজানের বাবা-মাও কবি ভাইয়ার কথায় সায় দিলেন। রোজানের চোখেমুখে দেখা গেল স্বাধীনতার খুশির ঝিলিক।