ভোর সকালে উঠেই কুশলের প্রতিদিনের কাজ এটি। বারান্দার পাশে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো। জানালা থেকে একটু দূরে টুনটুনি পাখির বাসা। টুনটুনি নামে পাখি আছে সেটা কুশল জানে। তবে এই পাখি টুনটুনি কিনা কুশল তা জানে না। তা সত্ত্বেও সে নিজেই এই নাম দিয়েছে। কারণ টুনটুনি নামটি তার খুব পছন্দ।
টুনটুনি পাখি দুটো যখন ছোট্ট বাসায় আরাম করে বসে থাকে তখন সেই দৃশ্য দেখতে কুশলের খুব ভাল লাগে। সকালে সূর্য্যি মামা উঠার সাথে সাথে পাখিরাও জেগে ওঠে। তারপর কিছুক্ষণ গা ঝাড়া দিয়ে একসাথে তারা উড়ে যায় অজানার উদ্দেশে। দিনশেষে আবার তারা ফিরে আসে। এই চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা কুশল প্রায় নিয়ম করে দেখে। রুটিন করে স্কুলে যাওয়া, সময়মত পড়তে বসার মতো এটাও তার একটা নিত্যদিনের রুটিন।
পাখিরা প্রতিদিন একই সময় বাসায় ফিরে আসে। অবশ্য মাঝেমধ্যে তাদের ফিরতে একটু-আধটু দেরি যে হয় না তা নয়। তখন কুশলের চিন্তার অন্ত থাকে না। স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হলে তার মা-বাবা যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে রকম আর কি।
পাখিগুলোর কোনো অসুবিধা হল কিনা। কেন তারা এখনো ফিরছে না-এই রকম নানান ভাবনা কাজ করে কুশলের মধ্যে। তারপর পাখিরা যখন বাসায় ফিরে আসে তখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তো এইভাবে দিন যাচ্ছিল।
কুশল একদিন খেয়াল করল মা পাখিটা ডিম পেড়েছে। দুটো ডিম। কুশলের আনন্দ আর ধরে না। পাশাপাশি চিন্তাও বেড়ে গেল। ডিমগুলো বাসার খরকুটোর ফাঁক দিয়ে পড়ে যায় কি না। সাপ কিংবা অন্যকোনো প্রাণি এসে ডিমগুলো খেয়ে ফেলে কিনা।
যতোটা পারে কুশল বাসাটা আগলে রাখে। কিন্তু তার স্কুলে যেতে হয়। এছাড়া এখানে ওখানে আত্মীয়দের বাড়িও যেতে হয়। কিন্তু কুশলের মনটা পড়ে থাকে পাখির বাসায়।
দিনের বেলা পাখিগুলো খাবার সংগ্রহের জন্য বাসা ছেড়ে দূরে চলে যায়। তখন ডিমগুলো খুবই অরক্ষিত থাকে। আর এই সময়টার জন্যই কুশলের চিন্তাও বেড়ে যায়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কুশল ডিমগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যখন পাখিরা ফিরে আসে তখন সে চিন্তামুক্ত হয়। ডিমগুলো থেকে একদিন বাচ্চা ফুটবে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকে সে।
গ্রামের বাড়িতে কুশল মুরগির ছোট ছোট বাচ্চা দেখেছে। তার সমবয়সী খালাত বোন অর্ণা একটি বাচ্চা ধরে তার হাতে দিয়েছিল। কি নরম! একটু হাতে রেখেই বাচ্চাটা ছেড়ে দিয়েছিল কুশল। পাছে আবার মরে যায় এই ভেবে। কিন্তু পাখির বাচ্চা সে কোনো দিন দেখেনি। পাখির বাচ্চাগুলোও নিশ্চয়ই মুরগির বাচ্চা গুলোর মতো নরম আর তুলতুলে হবে। ইস্ বাচ্চাগুলোকে যদি সে হাতে নিয়ে আদর করতে পারত কী মজাই হতো। আরে কী ভাবছে সে। এখনও ডিম ফুটে বাচ্চাই বের হয়নি। তাছাড়া পাখির বাচ্চা আর মুরগির বাচ্চা কী এক হলো। মুরগি হল গৃহপালিত আর পাখিগুলো বন্য। তাই ওগুলো ধরা নিষেধ।
ডিমফুটে একদিন সত্যি সত্যি বাচ্চা বের হল। কুশলের আনন্দ আর ধরে না। দুটি ডিম থেকেই বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাগুলো খুবই ছোট। চোখও ফুটেনি। এতো ছোট বাচ্চা কী করে বেঁচে থাকবে এটা নিয়ে আবার নতুন করে চিন্তায় পড়ল কুশল। যদি কোনো শিকারি পশুপাখি এসে বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলে। ইহ্ কুশল আর ভাবতে পারছে না।
দূর ছাই। এর রকম হবে কেন। মা পাখিটাই ওদের আগলে রাখবে। যেভাবে ঠোঁটে করে খাবার খাইয়ে দেয় বাচ্চাগুলোকে। তাতে ওদের কেউ কিছু করতেই পারবে না। বাসার কাছে কোনো কিছু ভিড়তেই পাখিগুলো হইচই শুরু করে। এভাবেই তারা বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করে চলেছে। কুশল দেখে আর ভাবে বাচ্চাগুলোর জন্য পাখির কী মায়া! ঠিক ওর মা বাবা ওকে যেভাবে আদর যত্ন করে সে রকম আর কি।
কুশলের পরীক্ষা শেষ। কিছুদিন স্কুল বন্ধ থাকবে। এবার সে পাখির বাচ্চাগুলোকে ভাল করে দেখে রাখতে পারবে। আচ্ছা বাচাগুলো বড় হয়ে কী বাসা ছেড়ে চলে যাবে? কোথায় থাকে পাখিরা। কুশলের মন খারাপ হয়ে যায়। একদিন পাখিগুলো চলে যাবে ভেবে।
হঠাৎ কী থেকে কী হল কুশলের ভীষণ জ্বর। বাচ্চাগুলো ভালভাবে দেখে রাখবে তো দূরের কথা বিছানা থেকেই সে উঠতে পারে না। তার নিজের জন্য যওতাটা তারচেয়েও টুনটুনির বাচ্চাগুলোর জন্য তার খুব চিন্তা হতে লাগল। বাসায় ডাক্তার ডেকে আনা হল। ডাক্তার বলল ভয়ের কিছু নেই। ভাইরাল ফিভার। দু’একদিনের মধ্যেই সেরে উঠবে। তবে রেস্টে থাকতে হবে।
একদিন প্রচণ্ড ঝড় উঠল। গাছপালা সবকিছু খড়কুটোর মত ওড়ে যেতে লাগল। যে গাছটার ডালে পাখির বাসা সেই ডালটাও প্রচণ্ড জোরে আকাশ-পাতাল দুলতে লাগল। বাসাসুদ্ধ পাখির বাচ্চাগুলো পড়ে যাওয়ার অবস্থা। কুশল দোয়া দরূদ পড়তে লাগল। কিন্তু ঝড় কিছুতেই থামছে না। এক সময় ঝড়ে ডালটা ভেঙে গেল। পাখির বাচ্চাগুলোর তখন যে কী অবস্থা। কুশলের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে বিছানায় উঠে বসল। তার গা কাঁপছে বাচ্চাগুলোর অবস্থা ভেবে। সে জানালার দিকে তাকাল। দেখল গাছের ডাল যেমন ছিল তেমনই আছে। মা পাখিটা বাচ্চাগুলোকে ঠোঁট দিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে। আর বাচ্চাগুলো মহাআনন্দে তা খাচ্ছে। কুশল গায়ে চিমটি কেটে দেখল সে ঠিকই আছে। তাহলে ঝড়? জ্বরের ঘোরে সে কী স্বপ্ন দেখেছে। আহ্ বাঁচা গেল।
কুশলের স্বপ্ন
হারুন রশীদ
প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০১৭ , ১১:৪৪ এএম
প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০১৭ , ১১:৪৪ এএম
